সাধারণত সবুজ উদ্ভিদকে স্বনির্ভর বলা হয়, কারণ তারা ন্যভোজী (Autotrophic)। কিন্তু পরিবেশতান্ত্রিক দিক থেকে চিন্তা করলে দেখা যায়, সবুজ গাছপালাসহ কোনো জীবই ধ্বনির্ভর নয়। পাহপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ ও অন্যান্য জীবজন্তু একে অপরের দ্বারা প্রভাবিত এবং কমবেশি নির্ভরশীল।
একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ পর-পরাগায়নের জন্য (Cross pollination) কীটপতঙ্গের উপর এবং বীজ বিতরণের জন্য পশুপাখির উপর নির্ভরশীল। জীবকুল শ্বসনক্রিয়া দিয়ে যে কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂) গ্যাস ত্যাগ করে সবুজ উদ্ভিদকুল সালোকসংশ্লেষণের জন্য তা ব্যবহার করে। আবার সবুজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় যে অক্সিজেন (০₂) গ্যাস ত্যাগ করে, শ্বসনের জন্য জীবকুল সেটি ব্যবহার করে। তাছাড়া ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক এবং বিভিন্ন প্রকার জীবাণু দিয়ে গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ
বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়। এক কথায় বলা যায়, পারস্পরিক সংযোগ ও নির্ভরশীলতাই জীবনক্রিয়া পরিচালনার চাবিকাঠি। কাজেই জীবজগতে বিভিন্ন প্রকার গাছপালা এবং প্রাণীদের মধ্যে বিদ্যমান জৈবিক সম্পর্কগুলোকে সহাকখান (Symbiosis) নামে আখ্যায়িত করা যায়। আর সম্পর্কযুক্ত জীবগুলোকে সহবাসকারী বা সহাবস্থানকারী (Symbionts) বলা হয়। এই সহাবস্থানকারী জীবগুলোর মধ্যে যে ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটে তাকে মিথস্ক্রিয়া বলা হয়। উপরের আলোচনা থেকে এটিও পরিষ্কার হয়েছে যে মিথস্ক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী জীবগুলো পরস্পর আন্তঃনির্ভরশীল, কেউই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। পরিবেশবিজ্ঞানী ওডাম (Odum) বলেন যে এই আন্তঃনির্ভরশীল সম্পর্ক দুভাবে হতে পারে, যেমন:
(a) ধনাত্মক আন্তঃক্রিয়া (Positive interactions) যারা
(b) ঋণাত্মক আন্তঃক্রিয়া (Negative interactions) দ্বারা।
(c) ধনাত্মক আন্তঃক্রিয়া (Positive Interactions)
যে আন্তঃসম্পর্কে দুটি জীবের একটি অন্যটিকে সহায়তা করে, তাকে ধনাত্মক আন্তঃক্রিয়া বলে। এ ক্ষেত্রে সহযোগীদ্বয়ের একটি বা উভয়ই উপকৃত হতে পারে। লাভজনক এ আন্তঃক্রিয়ার দুটি প্রধান ধরন হলো মিউচুয়ালিজম (Mutualism) ও কমেনসেলিজম (Commensalism)।
(1) মিউচুয়ালিজম (Mutualism): সহযোগীদের উভয়ই একে অন্যের দ্বারা উপকৃত হয়। যেমন, মৌমাছি প্রজাতি, পোকামাকড় প্রভৃতি ফুলের মধু আহরণের জন্য ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায় এবং বিনিময়ে ফুলের পরাগায়ন ঘটে। অনেক পাখি এবং বাদুড় ফল খেয়ে বাঁচে এবং মলত্যাগের সাথে ফলের বীজও ত্যাগ করে। এভাবে বীজের স্থানান্তর হয় এবং উদ্ভিদের বিস্তার ঘটে। এ বীজ
নতুন গাছ সৃষ্টিতে সাহায্য করে। একটি শৈবাল এবং একটি ছত্রাক সহাবস্থান করে লাইকেন গঠন করে। ছত্রাক বাতাস থেকে জলীয় বাষ্প সংগ্রহ এবং উভয়ের ব্যবহারের জন্য খনিজ লবণ সংগ্রহ করে। অপরদিকে শৈবাল ভার ক্লোরোফিলের মাধ্যমে নিজের জন্য এবং ছত্রাকের জন্য শর্করাজাতীয় খাদ্য প্রস্তুত করে। রাইজোবিয়াম (Rhizobium) ব্যাকটেরিয়া শিমজাতীয় উদ্ভিদের (Leguminous plant) শিকড়ে অবস্থান করে গুটি (Nodule) তৈরি করে এবং বায়বীয় নাইট্রোজেনকে সেখানে সংবন্ধন করে। ব্যাকটেরিয়া এই নাইট্রোজেন সহযোগী শিম উদ্ভিদকে সরবরাহ করে এবং বিনিময়ে সহযোগী উদ্ভিদ থেকে শর্করাজাতীয় খাদ্য পেয়ে থাকে।
(ii) কমেনসালিজম (Commensalism): এ ক্ষেত্রে সহযোগীদের মধ্যে একজন মাত্র উপকৃত
হয়। অন্য সহযোগী সদস্য উপকৃত না হলেও কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। যেমন, রোহিণী উদ্ভিদ (apophyte) মূলের সাহায্যে নিজেকে মাটিতে আবদ্ধ করে এবং অন্য বড় উদ্ভিদকে আরোহণ করে উপরে উঠে। এরূপে অন্য বৃক্ষের উপর প্রসারিত হয়ে বেশি পরিমাণে আলো গ্রহণ করে। কার্ডল লতা খাদ্যের জন্য আশ্রয়দানকারী উদ্ভিদের উপর নির্ভর করে না এবং তার কোনো ক্ষতিও করে না। পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ (metabiont) বায়ু থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে, কিন্তু আশ্রয়দাতার কোনো ক্ষতি করে না। শৈবাল অন্য উদ্ভিদদেহের ভিতরে আশ্রয় নিয়ে বসবাস করে। কিন্তু আশ্রয়দাতার কোনো ক্ষতি করে না।
(b) ঋণাত্মক আন্তঃক্রিয়া
এ ক্ষেত্রে জীবদ্বয়ের একটি বা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঋণাত্মক আন্তঃক্রিয়াকে তিন ভাগে ভাগ করা
যায়- শোষণ, প্রতিযোগিতা ও অ্যান্টিবায়োসিস।
(i) শোষণ (Exploitation): এ ক্ষেত্রে একটি জীব অন্য জীবকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার
অধিকার থেকে বঞ্চিত করে নিজের অধিকার ভোগ করে। যেমন: স্বর্ণলতা। স্বর্ণলতা হস্টোরিয়া নামক চোষক অঙ্গের মাধ্যমে আশ্রয়দাতা উদ্ভিদ থেকে তার খাদ্য সংগ্রহ করে। কোকিল কখনো পরিশ্রম করে বাসা তৈরি করে না। কাকের বাসায় সে ডিম পাড়ে এবং কাকের দ্বারাই তার ডিম ফোটায়
(ii) প্রতিযোগিতা (Competition): কোনো নির্দিষ্ট স্থানে আলো, বাতাস, পানি ও খাদ্যের জন্য জীবগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। এ প্রতিযোগিতায় সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীবসমূহ টিকে থাকে এবং অন্যরা বিতাড়িত হয়ে থাকে। এটি ডারউইনীয় আন্তঃপ্রজাতিক ও অন্তঃপ্রজাতিক সংগ্রামের ভালো উদাহরণ।
(iii) অ্যান্টিবায়োসিস (Antibiosis): একটি জীব কর্তৃক সৃষ্ট জৈব রাসায়নিক পদার্থের কারণে যদি অন্য জীবের বৃদ্ধি এবং বিকাশ আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে বাধাপ্রাপ্ত হয় অথবা মৃত্যু ঘটে তখন সেই প্রক্রিয়াকে অ্যান্টিবায়োসিস বলে। অণুজীবজগতে এ ধরনের সম্পর্ক অনেক বেশি দেখা যায়। আলেক্সান্ডার ফ্লেমিংয়ের (1881- 1955) পেনিসিলিন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পেছনে ছিল পেনিসিলিয়াম ছত্রাক কর্তৃক একই কালচার প্লেটে রাখা ব্যাকটেরিয়াগুলোর অ্যান্টিবায়োসিস।
উপরের আলোচনা থেকে এটি বোঝা যায় যে পরিবেশে বিদ্যমান বিভিন্ন জীবের মধ্যে প্রতিনিয়ত ক্রিয়া- বিক্রিয়া হচ্ছে এবং প্রত্যেকটি উপাদান পরস্পরের সাথে আন্তঃ সম্পর্কযুক্ত। এই সম্পর্ক দিয়ে কেউ লাভবান হচ্ছে আবার কেউ ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছে। আর এভাবেই তারা পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে।